বিবিসি বাংলা প্রতিবেদন
গোপালগঞ্জে সহিংস পরিস্থিতির পেছনে এনসিপির দায় কতটা?
ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় :
১৮-০৭-২০২৫ ১২:০৫:৫৫ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৮-০৭-২০২৫ ১২:০৬:৪৩ অপরাহ্ন
ফাইল ছবি
বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির কর্মসূচিকে ঘিরে হামলা, সংঘর্ষে অন্তত চারজনের প্রাণহানির ঘটনার পর বুধবার রাত থেকে সেখানে কারফিউ অব্যাহত রাখা হয়েছে।
'মার্চ টু গোপালগঞ্জ' নামে ওই কর্মসূচি নিয়েছিল এনসিপি।
জুলাই আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের নতুন এই দলটি দেশের বিভিন্ন জেলায় তাদের পদযাত্রা কর্মসূচি চলাকালে ভিন্ন নামে গোপালগঞ্জ মুখে কর্মসূচি কেন নিয়েছিল, আর সেই কর্মসূচি উস্কানিমূলক পরিবেশ তৈরি করেছিল কি না-এ সব প্রশ্নে চলছে নানা আলোচনা।
এমন প্রেক্ষাপটে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, গোপালগঞ্জের ঘটনার ক্ষেত্রে এনসিপির দায় কতটা?
কর্মসূচির নাম নিয়েই প্রশ্ন
এনসিপি গত পহেলা জুলাই থেকে দেশজুড়ে 'জুলাই পদযাত্রা'র ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে।
জেলায় জেলায় যাওয়ার আগে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা পদযাত্রার কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েআসছিল।
কেবলমাত্র গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রেই দলটি কর্মসূচির ভিন্ন নাম দিয়ে তা ফেসবুকে ঘোষণা করে।
'মার্চ টু গোপালগঞ্জ' নামে ওই কর্মসূচি নিয়ে ফেসবুকে ঘোষনা দেওয়ার পর গতকাল বুধবার এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম দু'টো পোস্ট দেন।
প্রথমে তিনি লেখেন, "বিপ্লবের সহযোদ্ধারা, ধুমকেতুর মতো ছুটে আসুন।"
তার সবশেষ পোস্টের শেষ কথা ছিল, "আমরা সেই বাংলাদেশ গড়তে চাই, যে বাংলাদেশে গোপালগঞ্জের মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে, জেলার নাম দিয়ে আর বৈষম্য হবে না... গোপালগঞ্জ কোনো ব্যক্তি বা দলের সম্পত্তি নয়, গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের।"
অনেকেই মনে করছেন, এনসিপি যেভাবে গোপালগঞ্জ মুখে তাদের কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে, তা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উস্কে দিয়েছে, এর সঙ্গে সেখানকার মানুষের আবেগও কাজ করেছে।
ফলে সেখানে এনসিপির বুধবারের কর্মসূচির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বাঁধে এবং তা হামলা, সংঘর্ষ পর্যন্ত গড়ায়। কারণ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কবর রয়েছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়।
আর এমন প্রেক্ষাপটেই এনসিপির কর্মসূচি নিয়ে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
তবে এনসিপি নেতারা এ সব অভিযোগ মানতে রাজি নন।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, তারা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমে কোনো বক্তব্য দেননি।
"এটা শুধু প্রোগ্রামটাকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য করেছি। আমরা আলাদা শব্দ ব্যবহার করলে তা উস্কানি হতে পারে না। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছি। ওখানে উস্কানি ছিল না।"
একই বিষয়ে সারজিস আলমের সাথেও কথা হয় বিবিসি বাংলা'র। তিনি বলছিলেন, "এটা মেটাফোর হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। স্পেশাল কিছু না।"
"আমরা যুদ্ধের আহ্বান নিয়ে যাইনি। এটা আমাদের পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি। এটা এমন না যে বিশেষ কোনো আয়োজন নিয়ে আসছি।"
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপি নেতাদের ঘোষণায় শব্দের ব্যবহারে রাজনীতি স্পষ্ট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, "কিন্তু রাজনীতিতে পদযাত্রার যে অনুবাদ, হেঁটে মানুষের সাথে জনসংযোগ করা। তবে 'পদযাত্রা' যখন 'মার্চ' হয়ে যায়, এর একটা গতি থাকে।"
"পদযাত্রার বদলে মার্চ- শব্দটিই এখানে পাল্টে গেল। এখানে ভাষাগত পার্থক্যই কেবল নয়, এর মাঝে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, প্রস্তুতির পার্থক্য আছে। এর মাঝে কোনো পরিকল্পনা আছে।"
"এটা হঠাৎ করে কেন পাল্টে গেল? এটাকে মেটাফোরিক্যালি দেখার জায়গা নেই। মেটাফোরিক মানেই কিন্তু এই শব্দ দিয়ে আমি কিছু একটা বোঝাচ্ছি। এটার একটা ইন্টার্নাল পলিটিক্স আছে বলে মনে করেন জোবাইদা নাসরীন।
এই 'মার্চ' শব্দটিই গোটা পরিস্থিতিকে আরও বেশি উস্কে দিয়েছে বলে মনে করছেন এই বিশ্লেষক।
বাস্তবতা কি এনসিপি জানতো?
গোপালগঞ্জই বাংলাদেশের একমাত্র জেলা, যেখানে ২০২৪ সালের পাঁচই আগস্টের পর সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা কয়েকদিন ধরে প্রতিবাদ করেছিলেন।
এদিকে, বুধবার গোপালগঞ্জে এনসিপি'র কর্মসূচির আগে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা চলছিলো। যেমন, ১৬ই জুলাই গোপালগঞ্জ দখল করবে এনসিপি। কিংবা, সরকার পতনের পর যেমন দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়েছে, ঠিক সেভাবেই শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিও ভেঙ্গে ফেলা হবে।
তবে এনসিপি'র কেন্দ্রীয় নেতারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, তাদের এমন কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।
তাদের বক্তব্য হচ্ছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেকোনো দল বাংলাদেশের যেকোনো জেলায় সমাবেশ করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শ অনুযায়ী যদি একেকটি জেলাকে একেকটি দলের একচ্ছত্র রাজনীতির জন্য বৈধতা দেওয়া হয়, তাহলে সেখানকার সাধারণ মানুষ নির্যাতিত হয় এবং ক্ষমতা চলে গেলে তারা জেলার সদস্য হিসাবেই অনেককিছু থেকে বঞ্চিত হয়।
গোপালগঞ্জে সমাবেশের পেছনে কোনো উদ্দেশ্য ছিল না দাবি করে এনসিপি নেতা আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, তাদের কাছে মনে হয়েছিলো যে গোপালগঞ্জে পরস্থিতি জটিল হতে পারে।
"অন্য জায়গায় পদযাত্রায় আমরা পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার হাঁটি। এখানে এই পরিস্থিতি হতে পারে, তা আমাদের মনে হয়েছিল। তাই, এখানে শুধু সংক্ষিপ্ত সমাবেশ ছিল। কিন্তু আ'লীগ যে এভাবে সশস্ত্র হামলা করবে, তা আমাদের ধারণায় ছিল না," বলছিলেন তিনি।
এনসিপি নেতা সারজিস আলমও বলেন, "এতদিন ধরে এরকম একটি মেসেজ ছিল যে, গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগের এমন ঘাঁটি, যেখানে অন্য কোনো দলের এখানে কোনো অস্তিত্ব থাকবে না, অন্য কারো কোনো প্রোগ্রাম থাকবে না...সেই জায়গা থেকে আমরা গেছি...ওই সাহসটুকু নিয়ে গেছি"
গোপালগঞ্জে হতাহতের দায় কার?
এদিকে, গোপালগঞ্জে হতাহতের ঘটনা এবং যে পরিস্থিতি তৈরি হলো, তার দায় নিতে রাজি নয় এনসিপি।
দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, তারা কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেন না।
বুধবার গোপালগঞ্জে তারা চারজনের নিহত কথা শুনেছেন উল্লেখ করে তিনি লেখেন, "প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থা যদি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতো, তাহলে এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না।"
"এ দায়ভার সরকার ও প্রশাসনকে নিতে হবে," বলেও লেখেন তিনি।
গোপালগঞ্জে বুধবার দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশের ও ইউএনও'র গাড়িতে, এনসিপি'র সভামঞ্চে হামলা চালানো হয়। এসব হামলার ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে।
তবে পরিস্থিতির জন্যএনসিপিও দায়এড়াতে পারে কি না,এই প্রশ্নও রয়েছে। এ ব্যাপারে সারজিস আলম বলেন, "এই জিনিসটা ভিক্টিম ব্লেমিং। ওখানে গিয়ে আমরা ভিক্টিম হলাম। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা করলো... তাহলে আমরা কি গোপালগঞ্জকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল হিসাবে রেখে দিবো? ওখানে কি দল হিসাবে আমাদের সমাবেশ করার অধিকার থাকবে না?"
তিনি এ-ও বলেন, এই ঘটনার দায় প্রশাসনকে নিতে হবে। কারণ তারা অন্যান্য জেলার মতো গোপালগঞ্জেও প্রশাসনের সাথে কথা বলে, নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিশ্চিত করে, প্রশাসনের দেওয়া সকল নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে গোপালগঞ্জে যান।
"তারা (আ'লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থকরা) এই সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড না চালালে এটি হতো না। কারণ এটা তো পদযাত্রাই ছিল। ওইখানে যেন অপ্রত্যাশিত কিছু না হয়, তাই পদযাত্রা না করে আমরা শুধু পথসভা করছি। চারজনের নিহতের দায়ভার প্রশাসনের নিতে হবে"উল্লেখ করেন সারজিস আলম।
এনসিপি নেতারা মনে করেন, বুধবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট সক্রিয় ছিল না।
যদিও সমাবেশ শেষ করে এনসিপি নেতারা যখন ব্যাপক হামলার মুখে শহর থেকে বের হতে পারছিলেন না, তখন তাদেরকে আশ্রয় দেওয়া হয় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এবং পরবর্তীতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের কড়া পাহারায় গোপালগঞ্জ ছাড়েন তারা।
এনসিপি নেতারা মনে করছেন, "ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে" প্রশাসন যতটা কঠোরতা দেখিয়েছে, শুরু থেকেই তারা একইরকম ভূমিকা পালন করলে এই পরিণতি হতো না।
"পুলিশ, সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা, সবার কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স পেয়ে গেছি। যাওয়ার পথে প্রশাসনের লোকজন দাঁড়াইতে বলছে, দাঁড়াইছি। তারা ক্লিয়ারেন্স দিছে, গেছি।"
"সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স না দিলে আমরা চলে যেতাম। অন্য একদিন করতাম," বলেন মি. আলম।
এদিকে, অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এনসিপি গোপালগঞ্জে সমাবেশ করেছে এবং এটিকে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল ঘটনা বলে মনে করছেন।
"সকলের নিরাপত্তা দেওয়া নিশ্চয়ই সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু অন্যক্ষেত্রে তো সরকারকে এতটা পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি" উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন করেন, "কেন একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশে সরকার এতটা পদক্ষেপ নিবে? সরকার এনসিপি'র পক্ষে ছিল।"
বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এইচবি/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স